ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার বিকালে তার মৃত্যু হয় বলে বাংলাদেশ পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
রাজ্জাকের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের কাস্টমার কেয়ারের ইনচার্জ উজ্জ্বল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর ৫টা ২০ মিনিটে হাসপাতালে আনা হয় রাজ্জাককে।
“তখন তার পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেন। সোয়া ৬টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।”
বেসরকারি হাসপাতালটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “হৃদরোগ ছাড়াও তিনি ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিসে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন।”
রাজ্জাক ও তার স্ত্রী লক্ষ্মীর (খায়রুন নেসা) তিন ছেলে বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং দুই মেয়ে শম্পা ও ময়না। তার ছেলেরাও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
ছেলে সম্রাট হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, “আমার বাবার জন্য আপনারা দোয়া করুন। তার মাগফেরাত কামনা করুন। আপনাদের এবং দেশবাসীর কাছে এখন সেটাই চাওয়া।”
পরে বড় ছেলে বাপ্পারাজ গুলশানে তাদের বাসায় সংবাদ সম্মেলনে জানান, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে তার বাবার মরদেহ। বেলা আড়াইটায় গুলশানের আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে হবে দাফন।
রাজ্জাকের মেজ ছেলে বাপ্পী এখন কানাডায় রয়েছেন। তার জন্য অপেক্ষা করতে চাইলেও তার ফিরতে শুক্রবার লেগে যাবে বলে সিদ্ধান্ত বদলানো হয় বলে জানান সম্রাট।
রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর পেয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকে ভিড় জমান ইউনাইটেড হাসপাতালে; শোক বিহ্বল অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছুটে যান তার বাড়ি লক্ষ্মীকুঞ্জতেও।
রাতে গুলশানে রাজ্জাকের বাড়ি লক্ষ্মীকুঞ্জে যান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। প্রয়াতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, রাজ্জাকের শেষকৃত্যে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
রাজ্জাককে ‘জাতীয় ব্যক্তিত্ব’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, “বাংলা চলচ্চিত্র তার হাত ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। যখন লাহোর, কলকাতা ও বোম্বের সিনেমায় ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে মাতামাতি করে থাকত, তখন রাজ্জাক সাহেবের হাত ধরে বাংলাদেশের বাঙালিরা পরিচয় ফিরে পেয়েছে। তারা গর্ববোধ করেছে যে আমরাও ছবি তৈরি করতে পারি।”
অভিনেতা রাজ্জাকের কাজগুলোর সঙ্কলিত করে তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশ করবে বলে জানান ইনু।
চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীদের সংগঠন শিল্পী সমিতির প্রথম সভাপতি রাজ্জাকের মৃত্যুতে শোকার্ত বর্তমান সভাপতি মিশা সওদাগর বলেন, গোটা চলচ্চিত্র পরিবারই এখন ‘পিতাশূন্য ও এতিম’ হয়ে গেল।
“বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি একাই বহন করে গেছেন, এখন স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেল।”
ইউনাইটেড হাসপাতালে অভিনেতা ও এফডিসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘কিংবদন্তী’ অভিনেতা রাজ্জাককে হারিয়ে গোটা চলচ্চিত্র পরিবার ‘অনুপ্রেরণা উৎসকে’ হারিয়ে ফেলেছে।
হালের অভিনেতা ফেরদৌস বলেন, “এমন একটা সিচুয়েশনে তিনি চলে গেলেন, যখন অভিভাবক হিসেবে তাকে বড় প্রয়োজন ছিল।”
অভিনেতা রাজ্জাকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
পাঁচশর বেশি চলচ্চিত্রের অভিনেতা আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশের মানুষের কাছে নায়করাজ নামেই খ্যাত ছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সাদা কালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেন রাজ্জাক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ২৫ বছর প্রায় একাই টেনেছেন এই চিত্রনায়ক।
শেষ দিকে অন্য চরিত্রে অভিনয় করলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন তাকে চিরসবুজ নায়ক হিসেবেই দেখত।
হালের অভিনেতা রিয়াজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “হি ইজ দ্য কিং। আমাদের কাছে তিনি এখনও রাজা। একারণেই নায়করাজকে আমরা সবাই এখনও ফলো করি। তার কথা বলার স্টাইল, অভিনয়- সব কিছুই আমরা ফলো করি। তাকে দেখে বড় হয়েছি, তাকে ফলো করেই আমরা অভিনয় শিখেছি।”
রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। শৈশবেই তিনি বাবা-মাকে হারান।
টালিগঞ্জের খানপুর হাইস্কুলে পড়ার সময় নাটকে অভিনয় করেন রাজ্জাক। কলেজে পড়ার সময় তিনি ‘রতন লাল বাঙালি’ নামে একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।
অভিনেতা হওয়ার মানসে ১৯৬১ সালে কলকাতা থেকে মুম্বাই পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি; সেখানে সফল না হয়ে ফিরেছিলেন টালিগঞ্জে।
কলকাতায়ও পরিস্থিতি অনুকূলে না হওয়ায় ১৯৬৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন রাজ্জাক। টিকে থাকতে এই সময় বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছিল তাকে।
১৯৬৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হলে সেখানে অভিনয়ের সুযোগ নেন রাজ্জাক। তখন ধারাবাহিক নাটক ‘ঘরোয়া’য় অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্রে অভিনয় করা। আবদুল জব্বার খানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান তিনি তবে নায়ক হিসেবে নয়। সহকারী পরিচালক হিসেবে।
রাজ্জাক নিজেই বলে গেছেন, “আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি, না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনোদিন আসেনি।”
সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মধ্যেই ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয় করেন রাজ্জাক। এরপর ‘ডাকবাবু’, উর্দু ছবি ‘আখেরি স্টেশন’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।
এক সময় জহির রায়হানের নজরে পড়েন রাজ্জাক। তিনি ‘বেহুলা’য় লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দিলেন রাজ্জাককে, সুচন্দার বিপরীতে। ‘বেহুলা’ ব্যবসাসফল হওয়ায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে।
সুদর্শন রাজ্জাক সুচন্দার পর শবনম, কবরী, ববিতা, শাবানাসহ তখনকার প্রায় সব অভিনেত্রীকে নিয়ে একের পর এক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র দেন ঢালিউডকে। এর মধ্যে রাজ্জাক-কবরী জুটি ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়।
সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজ্জাক-কবরী জুটির শুরু। এরপর একের পর এক ছবিতে অভিনয় করেছেন তারা। ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘ঢেউ এর পরে ঢেউ’ এবং স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্র উপহার দেন এই জুটি।
কবরী তার বইয়ে লিখেছেন, “সিনেমামোদী যারা এসব সিনেমা দেখেছেন, তারাও হয়ে যেতেন রাজ্জাক আর অপরপক্ষ নিজেকে ভাবত কবরী, তাই না?”
রাজ্জাকের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’, ‘দুই ভাই’, ‘মনের মতো বউ’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বেঈমান’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’ দিয়ে বাংলাদেশে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের সূচনাও ঘটান রাজ্জাক।
রিয়াজ বলেন, “রংবাজ’ সিনেমায় যেভাবে নিজেকে ভেঙেছিলেন, আর সেই সিনেমা যেভাবে বাংলা ছবিতে একটা চেইঞ্জ নিয়ে এসেছিল, সেটা অনেকদিন মনে থাকবে।”
‘পিচ ঢালা পথ’, ‘স্বরলিপি’, ‘কি যে করি’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘আনার কলি’, ‘বাজিমাত’, ‘লাইলি মজনু’, ‘নাতবউ’, ‘মধুমিলন’, ‘অবুঝ মন’, ‘সাধু শয়তান’, ‘পাগলা রাজা’, ‘মাটির ঘর’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘কালো গোলাপ’, ‘নাজমা’সহ অসংখ্য ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের নায়ক রাজ্জাক।
তার অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র কার্তুজ, পরিচালিত শেষ চলচ্চিত্র আয়না কাহিনী।
অভিনয়ের জন্য রাজ্জাক পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে। ২০১৫ সালে তিনি পান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার।
বদনাম, সৎ ভাই, চাপা ডাঙ্গার বউসহ প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন রাজ্জাক। তার মালিকানার রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
অভিনয় জীবনের বাইরে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেন রাজ্জাক।