হোয়াইট হাউস: আমেরিকার কেন্দ্রবিন্দুর খুঁটিনাটি তথ্য
হোয়াইট হাউস আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এর সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই পদের ব্যক্তিটি সবসময়ই থাকেন সারা বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি বিশ্বের মানুষের কৌতুহল থাকাটা স্বাভাবিক। আসুন জেনে নিই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের এই বাসভবন সম্বন্ধে।
যেখানে অবস্থিত:
তিন তলা বিশিষ্ট সাদা রংয়ের এই বাড়িটি ১৬০০ পেনসিলভ্যানিয়া অ্যাভিনিউ, ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত।
যেভাবে হোয়াইট হাউস এর যাত্রা শুরু হয়:
হোয়াইট হাউস নামের এই ভবনটির যাত্রা শুরু হয় আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এর হাত ধরে এবং ভবনটির নকশা প্রণয়ন করেন আয়ারল্যান্ডের নাগরিক জেমস হোবন। ১৭৯২-১৮০০ সালের মধ্যে এই ভবনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জর্জ ওয়াশিংটন এর পরামর্শে জর্জ হোবন হোয়াইট হাউস এর নকশা তৈরি করে জমা দেন। এই নকশাটি আমেরিকার জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করল। খুব স্বাভাবিকভাবেই হোবনকে দেওয়া হল এ প্রাসাদ তৈরির সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও সঙ্গে ৫০০ ডলারের এক সাম্মানিক। স্বাধীনতার পর থেকে সব রাষ্ট্রপতিরই বাসভবন হয়ে ওঠে এটি, একমাত্র জর্জ ওয়াশিংটন ছাড়া।
নির্মাণগত তথ্য:
এটি শুধু রাষ্ট্রপতিদের বাসস্থানই নয়, অফিসও, প্রায় ১৮ একর জমিতে প্রসিদ্ধ বাগানসহ। এটি ১৭৯২ সালের ১৩ অক্টোবর স্থাপিত হয় এবং ১৮০০ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। তারও চৌদ্দ বছর পর, ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা আমেরিকা আক্রমণ করে ওয়াশিংটন শহরটি দখল করে এবং ৪ আগস্ট তারা হোয়াইট হাউসে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রাসাদটি। পরবর্তীতে ভবনটি পুন:নির্মাণ করতে তিন বছর সময় লাগে। বিট্রিশদের দেওয়া আগুনে ভবনের ভিতরের কিছু অংশ এবং বাইরের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর অল্প কিছুদিন পরই ভবনটি পুন:নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হয়। তবে শুরুর দিকের নকশার সাথে পরবর্তীতে নতুন আরও কিছু বিষয় যোগ হয় পরবর্তীতে। যেমন - ১৮২৪ সালে ভবনের দক্ষিণভাগের এবং ১৮২৯ সালে উত্তরদিকের স্তম্ভগুলো নির্মিত হয়। ১৯০৯ সালে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফ্ট্ ভবনের দক্ষিণ অংশ সম্প্রসারিত করেন এবং সর্বপ্রথম ওভাল অফিস প্রতিষ্ঠা করেন। ওভাল অফিস পরবর্তিতে ভবনের সম্প্রসারণের কারণে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। তৃতীয় তলার চিলেকোঠাটি ১৯২৭ সালে বাসযোগ্য করে তৈরি করা হয়। সামাজিক অনুষ্ঠানের অভ্যর্থনার জন্য ভবনটির পূর্ব দিকে একটি অংশ তৈরি করা হয়। তৈরিকৃত উভয় অংশই জেফারসনের নির্মিত স্তম্ভসারির সাথে সংযুক্ত করা হয়েছিল। এর পরও ১৯৫২ পর্যন্ত কিছু না কিছু কাজ হয়েছে হোয়াইট হাউসে। জানা যায়, হোয়াইট হাউসের মূল নকশাটি ডুবলিনে অবস্থিত লিনস্টার হাউসের আদলে প্রভাবিত যেটি বাল্টিমোর ম্যারিল্যান্ড হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে সযত্নে রক্ষিত। ভবনটির সার্বিক তত্তাবধানে রয়েছে United States Secret Service এবং United States Park Police।
নামকরণ:
প্রথমদিকে সুরম্য এই ভবনটির নাম হোয়াইট হাউজ ছিল না। প্রথমদিকে ভবনটির রং ছিল ধূসর রংয়ের। ব্রিটিশ সৈন্যদের দেওয়া আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর ভবনটি পুন:নির্মাণ করা হয়। তখন ধূসর রংয়ের পরিবর্তে ধবধবে সাদা রংয়ে রাঙানো হয় ভবনটিকে। ভবনটির দেয়ালে আগুনের পোড়া দাগ ও ধোঁয়ার ছাপ ঢাকার জন্য দেয়ালের ওপর সাদা রংয়ের প্রলেপ দেওয়া হয়। সেই থেকে এটি হোয়াইট হাউস নামে পরিচিত। এছাড়া আমেরিকাতে আরও বিভিন্ন নামে পরিচিত এই ভবনটি। যেমন - প্রেসিডেন্টস প্যালেস, প্রেসিডেন্টস হাউস, এক্সিকিউটিভ ম্যানসন ইত্যাদি। তবে ১৯০১ সালে থিয়োডোর রুজভেল্ট তাঁর ব্যবহৃত নিজস্ব কাগজপত্রে, ব্যক্তিগত প্যাডে হোয়াইট হাউস নামটি ছাপিয়ে ব্যবহার করার পর থেকেই সরকারিভাবে এই নামটি চালু হয়।
ভিতরে যা কিছু আছে
তিন তলা বিশিষ্ট ভবনের দ্বিতীয় তলাতেই বাস করেন রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যরা। তাদের সাথে সেখানে আরও বাস করেন সরকারি কিছু কর্মী ও আত্মরক্ষা বাহিনী। রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো রয়েছে নিচতলাতে। হোয়াইট হাউসে মোট ১৩২টি কক্ষ রয়েছে। ছয়তলা বিশিষ্ট এই ভবনটিতে মোট ৩৫টি বাথরুম রয়েছে। সম্পূর্ণ হোয়াইট হাউস ঘুরতে সময় লাগবে কয়েক ঘন্টা। পুরো ভবনের মেঝের আয়তন প্রায় ৫৫,০০০ বর্গফুট। সাধারণত হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা, সাহায্যকারী, খানসামা, রাঁধুনী, মালিসহ মোট ১ হাজার ৭০১ জন কর্মচারী থাকে।
হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করতে চাইলে
২০ শতক এর শুরুর দিকে হোয়াইট হাউস সকলের জন্য উন্মক্ত ছিল। ১৯৭৪ এ আর্মি এর চুরি যাওয়া একটি helicopter বিনা অনুমতিতে হোয়াইট হাউস এ অবতরণ করে ফেলে। ১৯৯৪ সালে একটি হাল্কা ওজনের বিমান হোয়াইট হাউস এর মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এই কারনে হোয়াইট হাউসের উপর দিয়ে কোন বিমান উড়ে যেতেও কতৄপক্ষ এর অনুমতি লাগে এবং যে কেউ চাইলেই ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। অনেক আমেরিকান আছেন যারা দেয়াল টপকে বিভিন্ন সময় হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন। তবে এর জন্য তাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। অনেককে গুলি খেয়ে মৃত্যুও বরণ করতে হয়েছে। এই মূহুর্তে হোয়াইট হাউস পরিদর্শনের একমাত্র উপায় ‘গুগল আর্থ’।
ভুতুরে বাড়ি:
ভূতুড়েবাড়ি হিসেবে যেটির নাম বেশি খ্যাতি পেয়েছে সেটি হল মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধানের আবাসস্থল হোয়াইট হাউস। এ ভবনের ভূত নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। অবশ্য হোয়াইট হাউসে ভূতদের আনাগোনা যখন ছিল, সে সময় নাকি বাড়িটি এত সুরক্ষিত ছিল না। প্রথম মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে হোয়াইট হাউসে বসবাস করেছিলেন জন অ্যাডামস। সে সময়ের ফার্স্ট লেডি অ্যাবেগেইল অ্যাডামস জামাকাপড় ধোওয়ার পর ইস্ট রুমে এসে সেগুলোকে শুকোতেন। ফার্স্ট লেডির মৃত্যুর পরও তাকে ওইভাবে কাপড় শুকোতে দেখেছেন অনেকে। হোয়াইট হাউসের বহু ভূতের মধ্যে অ্যাবেগেইল অ্যাডামসের ভূতই নাকি সবচেয়ে পুরনো বলে মনে করা হয়। তবে এ বাড়ির জনপ্রিয়তম ভূত নাকি রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের ভূত। হোয়াইট হাউসের অনেক পরিচারকই রাতে ঘরের মধ্যে লিংকনের উপস্থিতি অনুভব করেছে। সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি গ্রেস কুলিজও একবার ওভাল অফিসের জানালায় নাকি লিংকনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন! লিঙ্কন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনই হোয়াইট হাউসে তার ছেলে উইলি মারা যান। ইউলির আÍাকেও নাকি মাঝেমধ্যে দেখতে পাওয়া যায় বাড়িতে। আর এক সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান অ্যাণ্ড্র– জ্যাকসনের প্রিয় ঘর ছিল ‘রোজ রুম’। এই রোজ রুমেই নাকি তার অট্টহাসি আর শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনেছেন কেউ কেউ। ডেভিড বার্নস নামে এক ভদ্রলোকের জমিতে তৈরি হয়েছিল হোয়াইট হাউস। এখনও নাকি বাড়ির কয়েকটি ঘরে শোনা যায় এক অশরীরীর গলার স্বর। ‘আমিই বার্নস’, বলতে বলতে নাকি এঘর সেঘর ঘুরে বেড়ায় সেই আওয়াজ।
হোয়াইট হাউস এক বন্দীশালা:
আমেরিকান ফাস্ট লেডিদের কাছে হোয়াইট হাউস নাকি বন্দিশালা। একথা শুনলে যে কারোর চোখ ছানাবড়া হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ‘এবিসি’ চ্যানেলের এক ‘টক শো’তে মিশেল ওবামা হোয়াইট হাউসকে ‘সুন্দর, সুরম্য জেলখানা’ হিসেবে অভিহিত করে বোমা ফাটিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে মিশেল দেশটির প্রথম ফার্স্ট লেডি মার্থা ওয়াশিংটনের এক চিঠির কথা উল্লেখ করেন। চিঠিতে মার্থা ওয়াশিংটন তার ভাইঝিকে লিখেছিলেন- হোয়াইট হাউসে তিনি দেশের প্রধান কয়েদি হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করছেন। কারণ তার বদ্ধ, সীমানাটানা জীবন বন্দিশালার জীবনের মতই লাগে।
No comments:
Post a Comment